বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের পর্যটন শিল্পের অবস্থা নিয়ে পরিচালিত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। এই জরিপে তাদেরকেই পর্যটক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যারা কোথাও ঘুরতে গিয়ে অন্তত এক রাতের জন্য বাইরে থেকেছেন। ‘ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট’ নামে পরিচালিত এই জরিপে দেশের অভ্যন্তরে পর্যটকদের সংখ্যা, তাদের ভ্রমণ ব্যয়, এবং পর্যটন খাতের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান সম্পর্কিত নানা তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি থেকে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে কোন কোন জায়গা সবচেয়ে জনপ্রিয়। এতে পর্যটকদের ঘোরার জন্য ২৪টি স্থানের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রথম ১০টি স্থান বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
১. কক্সবাজার
দেশের ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে কক্সবাজার সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য। এ কারণেই একে ‘পর্যটন রাজধানী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের মোহনীয় নোনাজলে পা ভেজাতে সারা বছরই এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্যও কক্সবাজার অন্যতম আকর্ষণ, বিশেষ করে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত মেরিন ড্রাইভ সড়কটি। পাশাপাশি কক্সবাজারে রয়েছে নানা বিনোদনকেন্দ্র ও পর্যটন স্পট, যা ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করে রাখে।

২. পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত পরিবার-পরিজনের সাথে কিছুটা শান্ত সময় কাটানোর জন্য আদর্শ গন্তব্য। সাগরের বুকে সূর্যাস্তের ম্লান আলো কিংবা তাজা সমুদ্র বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ এখানে সবসময়ই মুগ্ধ করে। সাম্প্রতিক সৌন্দর্যবর্ধনের ফলে পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে সৈকতের আকর্ষণ আরও বেড়েছে, ফলে পর্যটকদের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো।

৩. কুয়াকাটা, পটুয়াখালী
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, যা “সাগরকন্যা” নামেও পরিচিত, পর্যটকদের জন্য এক অনন্য গন্তব্য। এখানে দাঁড়িয়ে একই স্থানে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করা যায়, যা খুব কম সমুদ্রসৈকতে সম্ভব। দীর্ঘ বালুকাময় সৈকত, সমুদ্রের অথই জলরাশি, আর আশেপাশের গ্রামীণ পরিবেশ মিলে কুয়াকাটাকে করে তুলেছে প্রকৃতির এক অপরূপ নিদর্শন। ভ্রমণপিপাসুরা এখানে এলে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্যে ডুবে যাওয়ার সুযোগ পান, যা তাদেরকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে এই জায়গায়।

৪. শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার
শ্রীমঙ্গল, বাংলাদেশের ‘চায়ের শহর’ নামে পরিচিত, প্রকৃতির সৌন্দর্যের অপরূপ মেলবন্ধন। সবুজ চা-বাগানের বিশাল বিস্তার, ঢেউ খেলানো পাহাড়ি পথ, আর নির্মল বাতাস পর্যটকদের মনে এক অনাবিল শান্তির সঞ্চার করে। শ্রীমঙ্গলের চারপাশে ছড়িয়ে আছে একাধিক দর্শনীয় স্থান—লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বুনো প্রকৃতি, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের গর্জন, কিংবা হাইল হাওরের নিস্তব্ধ জলাভূমি। এসব আকর্ষণের পাশাপাশি শ্রীমঙ্গলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আধুনিক রিসোর্ট ও পাঁচ তারকা মানের হোটেল, যেখানে থেকে অতিথিরা চা-বাগানের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। বছরের প্রতিটি সময়ই শ্রীমঙ্গলের রূপ ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বিশেষ কিছু হয়ে ধরা দেয়, আর এ কারণেই পর্যটন জনপ্রিয়তায় এটি রয়েছে শীর্ষস্থানীয় তালিকায়।

৫. বান্দরবান
বান্দরবান, প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আঁধার, যেখানে মেঘ আর পাহাড়ের এক অদ্ভুত মিলনমেলা। এখানে পাহাড়চূড়ায় মেঘের আস্তরণে হারিয়ে যাওয়া যেন প্রতিটি ভ্রমণপ্রেমীর স্বপ্ন। বান্দরবানের নীলাচলের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য যেমন পর্যটকদের মুগ্ধ করে, তেমনি নীলগিরির মেঘমাখা সকালে ভেসে যাওয়া এক ভিন্ন অনুভূতি এনে দেয়। মেঘলা ও মিরিঞ্জার মতো জায়গায় ঘুরতে গেলে মনে হয়, প্রকৃতির গহীনে হারিয়ে যাচ্ছি। ঝুরি ঝরনার নির্মল জলধারায় স্নিগ্ধ প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায়। পাহাড়ি পথের আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে বা জীপের ছাদে বসে বান্দরবানের বিস্তীর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করার মুহূর্তগুলো সত্যিই ভোলার মতো নয়। এ কারণেই বান্দরবান বছরের পর বছর ধরে পর্যটকদের এক স্বপ্নময় গন্তব্য হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।

৬. সাজেক উপত্যকা, রাঙামাটি
সাজেক উপত্যকা, যাকে পাহাড়ের রানী বলা হয়, তার অবস্থান রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় হলেও এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের উপত্যকায় পৌঁছাতে হলে খাগড়াছড়ি দিয়ে যেতে হয়। সাজেকের বিশেষত্ব হচ্ছে পাহাড়ের চূড়ায় সাদা মেঘের অনন্য খেলায় মুগ্ধ হয়ে থাকা। ভোরের সূর্যোদয় থেকে সন্ধ্যার সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাহাড়ের গায়ে মেঘের আনাগোনা সাজেককে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রার সৌন্দর্য, যা পর্যটকদের হৃদয়ে অনন্তকালের জন্যে গেঁথে থাকে।
এখানে পর্যটকদের সেবার জন্য তৈরি হয়েছে শতাধিক রিসোর্ট ও কটেজ। প্রতিটি রিসোর্টের জানালা দিয়ে মেঘের দোলা দেখা যায়। প্রকৃতির এতটা কাছাকাছি থেকে মেঘে মেঘে ঢেকে যাওয়া সাজেক যেন প্রতিটি ভ্রমণকে করে তোলে অতুলনীয়।

৭. বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকশিল্পের ইতিহাস সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে, ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দূরদর্শী পরিকল্পনায় সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন দেশের বুকে ছড়িয়ে থাকা লোকশিল্পের গৌরবময় ঐতিহ্যকে তুলে ধরার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে লোকশিল্পের মাধুর্য পৌঁছে দেওয়ার নিরলস কাজ করছে।
ফাউন্ডেশনটিতে সংরক্ষিত রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কারুশিল্পীদের হাতে গড়া প্রায় পাঁচ হাজার মূল্যবান নিদর্শন। প্রতিটি নিদর্শনই যেন বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আমাদের শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। বয়নশিল্প, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, ধাতুর কারুকাজসহ অসংখ্য শিল্পকর্ম এখানে প্রদর্শিত হয়, যা শুধুমাত্র দেশের ইতিহাসের সাক্ষী নয়, বরং প্রমাণও যে বাঙালি সংস্কৃতির শিল্পবোধ কতটা সমৃদ্ধ।

৮. রাঙামাটি
রাঙামাটি জেলার অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে সারা বছর জুড়েই। এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কাপ্তাই হ্রদ, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কৃত্রিম হ্রদ। পাহাড়ঘেরা এই হ্রদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্রিক অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু যেমন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ, তেমনি রাজবন বিহার তার আধ্যাত্মিক পরিবেশ ও স্থাপত্যশৈলীর কারণে ভ্রমণপ্রেমীদের মুগ্ধ করে।
এছাড়াও শহরের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে আরও বেশ কিছু ছোট-বড় পর্যটনকেন্দ্র, যেগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে তৈরি। এখানে ভ্রমণকারীরা শুধু প্রকৃতির সান্নিধ্যেই সময় কাটান না, বরং স্থানীয় আদিবাসী সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গেও পরিচিত হতে পারেন। রাঙামাটির এ সবুজ ও শান্ত প্রান্তরে প্রকৃতির এক ভিন্ন রূপ প্রতিটি ঋতুতেই নতুন রঙে দেখা দেয়, যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে রাখে বারবার।

৯. সুন্দরবন
সুন্দরবন, যা দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য উদাহরণ, প্রকৃতি ও প্রাণীপ্রেমীদের জন্য চিরকালীন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ম্যানগ্রোভ বনের এই বিস্তীর্ণ এলাকা সমুদ্রের তীরে অবস্থিত, যেখানে শীতল বাতাস এবং জলরাশির রেশমি কোমলতায় মিশে যায় প্রকৃতির সুরম্য রূপ।
এটি শুধু একটি বন নয়, বরং জীববৈচিত্র্যে ভরপুর একটি দারুণ জগত। এখানে অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী, বিশেষ করে বিশ্বের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, এই অরণ্যের গহীনে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। পর্যটকরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুন্দরবনের অভিজ্ঞান লাভ করতে আসেন, যেখানে তারা প্রকৃতির শান্তি ও রহস্যের সাথে পরিচিত হন।
সুন্দরবনের এই অপরূপ সৌন্দর্য প্রকৃতি প্রেমীদের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, এবং দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে এসে নিখুঁত এক অভিজ্ঞতা অর্জন করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ অপূর্ব মেলবন্ধন ভ্রমণকারীদের জন্য এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার হাতছানি দেয়।

১০. বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা, ঢাকা
জাতীয় চিড়িয়াখানা, যা রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত, প্রাণীপ্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানে বনের বাঘ এবং সিংহদের জন্য দেওয়া হয়েছে বিশেষ নাম, যেমন বেঙ্গল টাইগারের দম্পতি টগর এবং বেলি, এবং জলহস্তীর নাম ফাল্গুনী। এই চিড়িয়াখানার ১৮৬ একর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দুটি লেকসহ শতাধিক প্রজাতির প্রায় ৩ হাজার পশুপাখি।
করোনা সংক্রমণের পূর্বে, প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার দর্শনার্থী এখানে আসতেন, প্রাণীদের রোমাঞ্চকর আচরণ এবং তাদের নানা কৌতূহলপূর্ণ কার্যকলাপ উপভোগ করতে। দর্শনার্থীদের জন্য এটি এক অমূল্য অভিজ্ঞতা, যেখানে প্রকৃতির অসাধারণ এই সৃষ্টিগুলোর নিকটে গিয়ে সময় কাটানোর সুযোগ মেলে। চিড়িয়াখানার এই প্রাণবৈচিত্র্য ভ্রমণকারীদের মনে সজাগ করে তোলে বন্যপ্রাণির প্রতি এক গভীর ভালোবাসা এবং তাদের সংরক্ষণের গুরুত্ব।

আরও যেসব জায়গায় বেশি যান মানুষজন
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান, যা দেশটির সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের উজ্জ্বল উদাহরণ। মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে স্বাধীনতার ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় সমুজ্জ্বল, আবার কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনের অপার সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
সিলেটের জাফলং, যেখানে পাহাড় ও নদী মিলিত হয়েছে এক অসাধারণ দৃশ্যে, সেইসাথে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া, যেখানে রয়েছে বাউলসম্রাট ফকির লালন শাহের মাজার—এগুলোও ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত স্থান। ঢাকার লালবাগ কেল্লা ইতিহাসের এক চিত্র তুলে ধরে, এবং দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির মুগ্ধ করে প্রতিটি দর্শনার্থীকে।
বগুড়ার মহাস্থানগড় প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের চিহ্ন, খাগড়াছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রশান্তি দেয় শহুরে জীবন থেকে বিরতিতে। নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এবং সিলেটের সীমান্তবর্তী লালাখাল শান্তির নিদর্শন।
সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সাক্ষী, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল ও বিছনাকান্দি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভাণ্ডার। আর বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, যেটি স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন, পর্যটকদের কাছে একটি দর্শনীয় স্থান। এসব স্থান দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সাক্ষী হয়ে আছে, যা পর্যটকদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ।
ভ্রমণ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজ ফলো করুন এবং আমাদের ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিন।