রাঙ্গামাটি সদর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শুভলং ঝর্ণা, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য নিদর্শন। বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১৪০ ফুট উঁচু থেকে গড়িয়ে পড়া বিশাল জলপ্রপাত কাপ্তাই লেকের সাথে মিশে এক মুগ্ধকর দৃশ্য তৈরি করে। শুকনো মৌসুমে পানি কম থাকলেও বর্ষায় ঝর্ণার প্রকৃত রূপে মুগ্ধ হন পর্যটকরা। শুভলং ঝর্ণায় যাওয়ার পথে পাহাড় আর লেকের সমন্বিত সৌন্দর্য এমন যে, দেখে মনে হবে যেন আপনি কোনো দূরদেশের স্বপ্নময় জগতে পৌঁছে গেছেন।
ঝর্ণার কাছাকাছি শুভলং পাহাড়ে ওঠার জন্য সিঁড়ি রয়েছে, যেখান থেকে পুরো রাঙ্গামাটির বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও কাপ্তাই লেককে এক নজরে দেখতে পাবেন। আপনি চাইলে ঝর্ণার শীতল পানিতে ডুব দিয়ে স্নানও করতে পারেন, যা ভ্রমণের ক্লান্তি মুহূর্তেই মুছে দেবে।
শুভলং ঝর্ণা দেখতে যাবেন কিভাবে
ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটিতে যাতায়াতের জন্য ফকিরাপুল মোড় এবং সায়দাবাদে অনেকগুলো বাস কাউন্টার পাওয়া যাবে। সাধারণত সকাল ৮ টা থেকে ৯ টা এবং রাত ৮:৩০ টা থেকে ১১ টার মধ্যে বাসগুলো রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এসি বাসে জনপ্রতি ভাড়া ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা এবং নন-এসি বাসের ভাড়া ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে থাকে।
চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি যেতে চাইলে অক্সিজেন মোড় থেকে গেইটলক বা ডাইরেক্ট বাসে চড়া উত্তম, যার ভাড়া ১৫০ টাকার মতো। এছাড়া রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে নৌকা রিজার্ভ করে শুভলং ঝর্ণা ও আশপাশের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখা যায়। সারাদিনের জন্য নৌকা ভাড়া করলে ১০০০-১৫০০ টাকার মধ্যে মোটামুটি সাইজের নৌকা পাওয়া যায়, যা ১০-১৫ জন পর্যন্ত যাত্রী ধারণ করতে পারে। শুভলং ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। আর যদি আপনার সঙ্গী কম হয়, তাহলে রিজার্ভ বাজার থেকে জনপ্রতি প্যাকেজ ট্যুরে অংশ নিয়ে শুভলংসহ অন্যান্য দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে পারবেন।
থাকবেন কোথাই এবং খাবেন কি?
শুভলং এলাকায় থাকার এবং খাওয়ার জন্য তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই, তাই建议 দিন-ভ্রমণের পরিকল্পনা করুন এবং রাঙ্গামাটিতে ফিরে আসুন। আপনি হালকা খাবার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন। যদি আপনি নৌকা ভাড়া করে পেদা টিং টিং এলাকায় যান, তবে সেখানে খাবারের ব্যবস্থা আছে।
রাঙ্গামাটিতে বিভিন্ন মানের গেস্ট হাউজ এবং আবাসিক হোটেল পাওয়া যায়। শহরের পুরাতন বাস স্ট্যান্ড ও রিজার্ভ বাজার এলাকায় লেকের কাছাকাছি হোটেল বুক করার চেষ্টা করুন, যাতে আপনি কাপ্তাই লেকের মনোরম পরিবেশ এবং শান্ত বাতাসের স্বাদ নিতে পারেন। এছাড়া, কম খরচে থাকার জন্য বোডিংয়ে থাকা সম্ভব, যদিও সেগুলোর অবস্থার ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।
বাজেটের মধ্যে থাকার জন্য কিছু উল্লেখযোগ্য আবাসিক হোটেলের নাম খুঁজে নিতে পারেন, যা আপনার ভ্রমণকে আরও আনন্দময় করবে।
রাঙ্গামাটির বিভিন্ন আবাসিক হোটেল ও পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সে থাকার জন্য বিভিন্ন রকমের বাজেট অনুযায়ী সুবিধা রয়েছে।
Parjatan Holiday Complex: এখানে প্রতি রাতের রুম ভাড়া ১,৬০০ টাকা থেকে ৬,০০০ টাকা পর্যন্ত। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, যা আপনাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে আরামদায়ক থাকার সুযোগ দেবে। অবস্থান: Hanging Bridge Rd, Rangamati। ফোন: +880-233-3371851।
Hotel Jum Palace: এই হোটেলে প্রতি রাতের রুম ভাড়া ১,৫০০ টাকা থেকে ৩,২০০ টাকা। এটি T&T এলাকায় অবস্থিত এবং আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা প্রদান করে। ফোন: 0351-61878, 01625100000।
Lakeshore Resort: কাপ্তাইয়ে অবস্থিত এই রিসোর্টে প্রতি রাতের রুম ভাড়া ৪,৫০০ টাকা থেকে ৬,৫০০ টাকা। এই রিসোর্ট থেকে লেকের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। ফোন: 01859-778065।
Hotel Green Castle: এখানে রুম ভাড়া ৬০০ টাকা থেকে ২,৫০০ টাকা পর্যন্ত। রিজার্ভ বাজারে অবস্থিত এই হোটেলটি আপনার বাজেটের মধ্যে থাকতে সুবিধাজনক। ফোন: 0351-71214, 0351-61200, 01726-511532, 01815-459146।
Motel George: এই মোটেলে প্রতি রাতের জন্য রুম ভাড়া ৫০০ টাকা থেকে ১,৮০০ টাকা। কলেজ গেটের কাছে অবস্থিত, এটি সাশ্রয়ী মূল্যের একটি বিকল্প। ফোন: 0351-63348, 01558-480701।
এসব হোটেল ও রিসোর্টে থেকে আপনি রাঙ্গামাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন এবং আরামদায়ক একটি ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রকৃতি ও সংস্কৃতির এক অপূর্ব মিলনস্থল, যেখানে একাধিক আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এখানে রয়েছে:
- ঝুলন্ত ব্রিজ: এটি একটি দর্শনীয় স্থাপনা, যা আপনাকে রাঙ্গামাটির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ দেয়।
- কাপ্তাই লেক: বিশাল এই লেকের শান্ত জল ও চারপাশের পাহাড় আপনাকে মুগ্ধ করবে।
- শেখ রাসেল ইকো পার্ক: প্রকৃতির মধ্যে বিচরণের জন্য এটি একটি চমৎকার স্থান।
- উপজাতীয় জাদুঘর: এখানে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখতে পাবেন।
- ঝুম রেস্তোরা: স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে এখানে আসা যায়।
- টুকটুক ইকো ভিলেজ: এটি একটি ইকোট্যুরিজম গন্তব্য, যেখানে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতে পারবেন।
- যমচুক: একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান, যেখানে আপনি শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন।
- নির্বাণপুর বন ভাবনা কেন্দ্র: এখানে প্রকৃতির মাঝে বসে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ পাবেন।
- রাজবন বিহার: এটি একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির, যা ধর্মীয় ও স্থাপত্যগত কারণে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।
- চাকমা রাজবাড়ি: ঐতিহ্যবাহী এই রাজবাড়ি স্থানীয় ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত করে।
- উপজাতীয় টেক্সটাইল মার্কেট: এখানে বিভিন্ন উপজাতীয় বস্ত্র ও হস্তশিল্প কেনার সুযোগ আছে।
- নৌ-বাহিনীর পিকনিক স্পট: পরিবারের সঙ্গে পিকনিকের জন্য একটি সুন্দর স্থান।
- রাজস্থলী ঝুলন্ত সেতু: এটি একটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, যা আপনাকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যায়।
- সাজেক ভ্যালি: পাহাড়ের মাঝে বিস্তৃত এই ভ্যালিতে ভ্রমণ করলে আপনাকে ভিন্ন একটি অভিজ্ঞতা দেবে।
- বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র: প্রযুক্তির নতুনত্ব সম্পর্কে জানার সুযোগ এখানে পাবেন।
- কাট্টলী বিল ও ন-কাবা ছড়া ঝর্ণা: প্রাকৃতিক জলাশয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এই স্থানগুলো পরিদর্শন করতে ভুলবেন না।
এইসব দর্শনীয় স্থান রাঙ্গামাটি জেলা ভ্রমণকে করে তুলবে আরোও আনন্দময় ও স্মরণীয়।
শুভলং ঝর্ণা ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা
শুভলং ঝর্ণার পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে বর্ষাকাল বা তার পরবর্তী সময় ভ্রমণ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শীতকালে সাধারণত ঝর্ণায় পানির স্তর খুবই কম থাকে, তাই এ সময় ঝর্ণার বিশালতা অনুভব করা সম্ভব নয়।
যদি আপনি একটি দলের সাথে সফর করেন, তাহলে খরচ অনেকটাই কমে যাবে। ছুটির দিন ও অফসিজনে যাতায়াত করলে আপনাকে কম খরচে ভ্রমণের সুযোগ হবে। ট্রলার বা বোট রিজার্ভ করার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন আপনার গন্তব্য কোথায় এবং তার অনুযায়ী দরদাম করুন।
লেকের পাশে হোটেল ঠিক করার চেষ্টা করুন যাতে আপনি লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। মনে রাখবেন, কিছু জায়গায় লেকের পানি গভীর হতে পারে; নামার আগে মাঝির সঙ্গে কথা বলুন। যদি আপনি সাঁতার না জানেন, তাহলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট নিতে ভুলবেন না।
একদিনে সাধারণত জনপ্রিয় স্পটগুলো ঘুরে ফেলা সম্ভব। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি থেকে দূরে থাকতে আপনার আচরণে সতর্ক থাকুন এবং স্থানীয় মানুষের সাথে শালীনতা বজায় রাখুন। এসব টিপস মেনে চললে আপনার শুভলং ভ্রমণ হবে আনন্দময় ও নিরাপদ।
ভ্রমণ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজ ফলো করুন এবং আমাদের ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিন।