পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে বিস্তীর্ণ সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাপ্তাই উপজেলা প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি। এখানে সবুজ পাহাড়, নীল জলের লেক আর পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা পথ আপনাকে মুগ্ধ করবে। কাপ্তাই লেক দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ, যার বিস্তৃতি প্রায় ১১,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এর চারপাশে ছোট-বড় পাহাড়, জলপ্রপাত, এবং লেকের মাঝে গড়ে ওঠা অসংখ্য দ্বীপ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়। পাহাড়ি বনাঞ্চল আর লেকের জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই অঞ্চল ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয়। বর্ষাকালে ঝর্ণাগুলো সবচেয়ে সুন্দর রূপে দেখা দেয়, তবে বছরের যেকোনো সময়েই কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার আমেরিকার অর্থায়নে কর্ণফুলি নদীর উপর একটি বাঁধ নির্মাণ করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন। এই বাঁধের ফলে রাঙামাটি জেলার প্রায় ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি প্লাবিত হয়ে বিশাল কাপ্তাই লেকের সৃষ্টি হয়। এ লেকটি আজকে দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃত্রিম হ্রদ হিসেবে পরিণত হয়েছে, যা রাঙামাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বাঁধ নির্মাণের পর এই লেক পার্বত্য অঞ্চলের জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছে।
যা যা দেখবেন
প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য কাপ্তাই লেক এক অসাধারণ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এনে দিতে পারে। নৌকা বা বোট ভাড়া করে লেকের নির্মল জলরাশিতে ভাসতে ভাসতে আশেপাশের পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। লেকের অপরূপ দৃশ্য দেখতে চাইলে প্যারাডাইস পিকনিক স্পট হতে ঘুরে আসতে পারেন। দলবদ্ধভাবে নৌ বিহার কিংবা প্যাডেল বোটে চড়ার সুযোগও রয়েছে এখানে। এছাড়া স্পিডবোট বা নৌকা রিজার্ভ নিয়ে পুরো কাপ্তাই লেক এবং আশেপাশের দর্শনীয় স্থান যেমন ঝুলন্ত ব্রিজ, শুভলং ঝর্ণা, এবং রাঙ্গামাটি শহর ঘুরে দেখতে পারবেন। লেকের কাছেই কর্ণফুলি নদীতে কায়াকিং-এর সুযোগ রয়েছে, যা রোমাঞ্চপ্রেমীদের জন্য বাড়তি আনন্দের। শেখ রাসেল ইকোপার্কে গিয়ে ক্যাবল কারের মজাও উপভোগ করা যেতে পারে।
কাপ্তাই লেক যাবেন কিভাবে
ঢাকার সায়েদাবাদ বা কমলাপুর থেকে সরাসরি বাসে করে কাপ্তাই পৌঁছানো যায়, সময় লাগে প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা। বাসভেদে জনপ্রতি ভাড়া ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে থাকে। আর যদি চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই যেতে চান, তাহলে বহদ্দারহাট বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রতি ৩০ মিনিট পরপর বাস ছেড়ে যায়, ভাড়া ৮০ থেকে ১২০ টাকা এবং সময় লাগে মাত্র ২ ঘণ্টা। ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম এসে, সেখান থেকে বহদ্দারহাট টার্মিনাল থেকে কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারবেন। এছাড়া বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ি হয়ে বড়ইছড়ি পর্যন্ত বাসে এসে, তারপর সিএনজি করে সহজেই কাপ্তাই পৌঁছানো সম্ভব। আর রাঙ্গামাটি থেকে সড়কপথে বাস বা সিএনজি, অথবা লেকের মাধ্যমে ট্রলারে করেও কাপ্তাই বাজারে যাওয়া যায়।
কাপ্তাই লেকে, কোথাই কি খাবেন
কাপ্তাই লেকের মাঝে গড়ে ওঠা ছোট ছোট দ্বীপে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ দেখা যায়, যেখানে চাইলে দুপুরের খাবারসহ প্রয়োজনীয় আয়োজন করা যায়। লেকের আশেপাশে যেমন বেরান্যে লেক শোর ক্যাফে, জুম রেস্তোরা কিংবা প্যারাডাইস ক্যাফেতে খাবারের স্বাদ নিতে পারেন। অন্যদিকে, একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতার জন্য নৌবাহিনীর ঘাঁটির পাশে অবস্থিত ভাসমান রেস্তোরাঁয় যেতে পারেন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকা এই ভাসমান রেস্তোরাঁ আপনাকে কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে খাওয়ার সুযোগ করে দেবে।
কাপ্তাই লেকে কোথায় থাকবেন
কাপ্তাইয়ে এখনও বাণিজ্যিক মানের হোটেল বা মোটেল তেমন গড়ে ওঠেনি, তাই রাতে থাকতে চাইলে আগে থেকেই ব্যবস্থা করে আসা ভালো। কাপ্তাইয়ের সরকারি রেস্ট হাউসগুলোতে থাকার ব্যবস্থা আছে, তবে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হবে। সেনাবাহিনী, পিডিবি, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বন বিভাগের রেস্ট হাউসগুলোতে অনুমতি নিয়ে কম খরচে থাকা সম্ভব। লেক প্যারাডাইস পিকনিক স্পটেও রাত কাটানো যায়, যদিও তার জন্য অতিরিক্ত খরচ গুনতে হতে পারে। যেহেতু রাঙ্গামাটি কাছেই, আপনি চাইলে রাঙ্গামাটির হোটেল বা মোটেলে থেকেও সহজেই কাপ্তাই ঘুরে আসতে পারেন।
রাঙ্গামাটিতে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে, যেখানে ভিন্ন বাজেটের ভ্রমণপ্রেমীরা নিজেদের পছন্দমতো ব্যবস্থা করতে পারেন। পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স রাঙ্গামাটির অন্যতম জনপ্রিয় হোটেল, যেখানে প্রতি রাতের জন্য রুম ভাড়া শুরু হয় ১৬০০ টাকা থেকে, এবং ভালো মানের রুম পেতে খরচ হতে পারে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। কাপ্তাইয়ের লেকশোর রিসোর্টে থাকতে চাইলে আপনাকে ৪৫০০ টাকা থেকে ৬৫০০ টাকার মধ্যে রুম ভাড়া করতে হবে।
এছাড়াও, হোটেল গ্রিন ক্যাসেলে ৬০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকার মধ্যে রুম পাবেন, যা কম বাজেটের পর্যটকদের জন্য বেশ সাশ্রয়ী। যদি একটু কম খরচে থাকার জন্য জায়গা খুঁজছেন, তাহলে মোটেল জর্জে ৫০০ থেকে ১৮০০ টাকার মধ্যে রুম পাওয়া যাবে। যেকোনো হোটেলে আগে থেকেই ফোন করে বুকিং নিশ্চিত করে নেওয়া ভালো।
কাপ্তাই লেকের আশেপাশে ঘুরে দেখার মতো বেশ কিছু আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে যা আপনার ভ্রমণকে আরও রঙিন করে তুলবে। লেকের নিকটেই অবস্থিত রাঙ্গামাটির বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজ, যা স্থানীয়ভাবে “সিম্বল অফ রাঙ্গামাটি” নামে পরিচিত। এছাড়া শুভলং ঝর্ণার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও মনোমুগ্ধকর, বিশেষত বর্ষাকালে ঝর্ণাটি তার পরিপূর্ণ রূপে দেখা দেয়।
কাপ্তাই বাঁধের কাছেই রয়েছে কর্ণফুলি নদী, যেখানে নৌ বিহারের মাধ্যমে নদীর অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এ ছাড়াও, নেভি একাডেমী এবং শেখ রাসেল ইকোপার্ক ভ্রমণকারীদের কাছে জনপ্রিয় গন্তব্য। ইকোপার্কের ক্যাবল কার চড়ে উপভোগ করতে পারেন পাহাড়ি সৌন্দর্য আর নদীর মিতালী।
ভ্রমণ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজ ফলো করুন এবং আমাদের ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিন।