মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত, বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সুন্দর জলপ্রপাত। প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু এই ঝর্ণা একসময় দেশের একমাত্র জলপ্রপাত প্রেমীদের গন্তব্য ছিল, যদিও বর্তমানে আরও কিছু জলপ্রপাত আবিষ্কৃত হয়েছে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত মাধবকুন্ড ইকোপার্ক ২৬৭ একর জুড়ে বিস্তৃত, যেখানে পর্যটকদের জন্য রেস্টহাউজ ও রেস্টুরেন্টের সুবিধা রয়েছে। ইকোপার্কের মেইন গেট থেকে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার হাঁটলেই মাধবকুন্ড ঝর্ণা দেখা যায়। এছাড়া কাছাকাছি পরিকুন্ড নামক আরও একটি ঝর্ণা রয়েছে, যেখানে পৌঁছাতে ঝিরিপথ ধরে ১০-১৫ মিনিট হাঁটতে হয়। ইকোপার্কে ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে চা বাগান, খাসিয়া পল্লী, শ্রী শ্রী মাধবেশ্বরের তীর্থস্থান, এবং বিভিন্ন ফল ও ফসলের বাগান।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
শীতকাল ভ্রমণের জন্যে উপযুক্ত সময় হলেও মাধবকুন্ড ঝর্ণায় শীতকালে পানির প্রবাহ কম থাকে। তাই ঝর্ণার প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে বর্ষাকাল বা তার আশেপাশের সময়ে ভ্রমণ করা উত্তম, কারণ তখন ঝর্ণায় পানির প্রবাহ থাকে পূর্ণমাত্রায়, যা ভ্রমণকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
ঢাকা থেকে কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে মাধবকুন্ড যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো বাসে ভ্রমণ করা। আপনি শ্যামলী বা এনা পরিবহনের বিয়ানীবাজারগামী বাসে উঠলে সরাসরি কাঠালতলী বাজারে নামতে পারবেন। এই ভ্রমণ আরামদায়ক এবং সময় সাশ্রয়ী। কাঠালতলী বাজার থেকে মাধবকুন্ডের দূরত্ব কম হওয়ায়, সেখান থেকে রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া করতে পারেন (১৫০-১৮০ টাকা), অথবা যদি কম খরচে যেতে চান, তাহলে লোকাল সিএনজিতে জনপ্রতি ২০-২৫ টাকার বিনিময়ে পৌঁছানো সম্ভব।
ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেন যেমন পারাবত, উপবন, বা জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্টেশনে নামতে হবে। ট্রেনের ভাড়া শ্রেণিভেদে ২৮০ থেকে ৬৩৯ টাকার মধ্যে এবং ভ্রমণের সময় হবে প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা। কুলাউড়া স্টেশন থেকে সরাসরি মাধবকুন্ড যাওয়ার জন্য রিজার্ভ সিএনজি নিতে পারেন, যার ভাড়া ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। যদি আপনি কম খরচে যেতে চান, তাহলে কুলাউড়া থেকে লোকাল সিএনজি নিয়ে কাঠালতলী বাজারে পৌঁছে সেখান থেকে আবার রিজার্ভ সিএনজি বা লোকাল সিএনজি নিয়ে মাধবকুন্ড যেতে পারবেন।
এভাবে আপনার যাত্রাপথ হবে সহজ এবং আপনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হবে স্মরণীয়।
মৌলভীবাজার থেকে মাধবকুন্ড যাবেন কিভাবে
মৌলভীবাজার শহর থেকে মাধবকুন্ড যেতে চাইলে দু’টি ভ্রমণ বিকল্প রয়েছে। প্রথমত, আপনি সিএনজি, জীপ, বা মাইক্রোবাস রিজার্ভ করে সরাসরি মাধবকুন্ড পৌঁছাতে পারেন, যা আরামদায়ক এবং দ্রুতগতির হবে। দ্বিতীয়ত, আপনি লোকাল বাসে বড়লেখা গামী বাসে উঠে কুলাউড়া পার হয়ে বড়লেখার আগের স্টপেজ কাঠালতলী বাজারে নামতে পারেন। সেখান থেকে রিজার্ভ বা লোকাল সিএনজি নিয়ে মাধবকুন্ডের দিকে যেতে পারবেন।
সিলেট থেকে মাধবকুন্ড যাবেন কিভাবে
সিলেট থেকে মাধবকুন্ডে পৌঁছাতে চাইলে আপনি কদমতলী বাস স্ট্যান্ড থেকে বড়লেখা হয়ে কুলাউড়া গামী বাসে উঠতে পারেন। alternatively, আপনি সরাসরি বড়লেখা চলে আসতে পারেন। বড়লেখায় পৌঁছানোর পর, রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে মাধবকুন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারেন। এছাড়া, বড়লেখা থেকে লোকাল সিএনজি নিলে কাঠালতলী বাজারে গিয়ে সেখান থেকে আবার রিজার্ভ বা লোকাল সিএনজি নিয়ে মাধবকুন্ড যেতে পারবেন।
শ্রীমঙ্গল থেকে মাধবকুন্ড যাবেন কিভাবে?
শ্রীমঙ্গল থেকে মাধবকুন্ডে পৌঁছানোর জন্য আপনার কাছে দুটি সহজ বিকল্প আছে। আপনি চাইলে সরাসরি সিএনজি বা জীপ রিজার্ভ করে মাধবকুন্ড যেতে পারেন। অন্যদিকে, আপনি বড়লেখা গামী লোকাল বাসে চড়েও যেতে পারেন। এই ক্ষেত্রে, বড়লেখার আগে কাঠালতলী বাজারে নামতে হবে। তারপর সেখান থেকে রিজার্ভ বা লোকাল সিএনজি নিয়ে মাধবকুন্ড ইকোপার্কের দিকে যাত্রা করতে পারেন।
মাধবকুন্ডে থাকবেন কোথায়
মাধবকুন্ডে থাকার জন্য জেলা পরিষদের অধীনে দুটি বাংলো এবং দুটি আবাসিক হোটেল রয়েছে, যেখানে আপনি আগাম বুকিং দিয়ে থাকতে পারেন। তবে যদি আপনি সিলেট, মৌলভীবাজার বা শ্রীমঙ্গলে রাতে কাটান, তাহলে পরদিন যেকোনো জায়গায় যাত্রা করা অনেক সহজ হবে। এসব এলাকায় থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে, তাই আপনি আপনার পছন্দ অনুযায়ী হোটেল বা কটেজ বেছে নিয়ে রাত্রিযাপন করতে পারেন।
মাধবকুন্ডে খাবেন কোথায়
মাধবকুন্ডে কিছু মাঝারি মানের রেস্টুরেন্ট রয়েছে, তবে খাবারের দাম তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। সেক্ষেত্রে, আপনি প্রয়োজন অনুযায়ী বাইরে থেকে খাবার কিনে নিয়ে যেতে পারেন। অথবা সিলেট ফিরে জিন্দাবাজার এলাকায় পানসী, পাঁচ ভাই বা পালকি রেস্টুরেন্টে প্রায় ৩০ ধরনের ভর্তা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। মৌলভীবাজার বা শ্রীমঙ্গলে অনেক ভালো মানের খাবার হোটেল রয়েছে, যেখানে আপনি আপনার পছন্দের খাবার উপভোগ করতে পারবেন।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের পাশাপাশি মৌলভীবাজারে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আপনার সফরের সময়সীমা ও আকর্ষণীয় স্থানগুলো বিবেচনা করে একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন। মৌলভীবাজারের কিছু চমৎকার স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, চা বাগান, হামহাম ঝর্ণা, বাইক্কা বিল, মাধবপুর চা বাগান ও লেক, নবাব বাড়ি, হাকালুকি হাওর, মনিপুরী পল্লী, এবং আরও অনেক জায়গা। এইসব স্থানে ভ্রমণ করে আপনি মৌলভীবাজারের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির গভীর অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবেন।
মাধবকুন্ড ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা
কম খরচে মাধবকুন্ড জলপ্রপাত ভ্রমণ করতে চাইলে ট্রেন ও লোকাল সিএনজি ব্যবহার করে যাতায়াতের সুবিধা নিতে পারেন। একসঙ্গে দলে বেড়ালে খরচ আরও কমানো সম্ভব, সেক্ষেত্রে সিএনজিতে কতজন বসবে তা পরিকল্পনা করুন। মাধবকুন্ডে একদিনেই সবকিছু ঘুরে দেখা সম্ভব; আগের রাতে রওনা হয়ে সারাদিন ভ্রমণের পর রাতে ফিরে যেতে পারেন। স্থানীয় পরিবহনের ক্ষেত্রে ভাড়া নিয়ে দরদাম করা উচিত, কারণ টুরিস্ট হিসেবে বেশি টাকা চাওয়া হতে পারে।
যদি সিজন কিংবা ছুটির দিনে যান, তাহলে সিএনজি বা জীপের ভাড়া কিছুটা বেশি লাগবে। বর্ষাকালে ঝর্ণার উত্তাল রূপ দেখা যায়, তবে মনে রাখবেন যে ঝর্ণার আশেপাশের পাথর অনেক পিচ্ছিল, তাই হাঁটার সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। স্থানীয় নোটিশ বোর্ডে দেওয়া নির্দেশনাগুলি অনুসরণ করুন এবং ঝর্ণার নিচে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না, কারণ সেখানে অনেক গভীর পানি থাকতে পারে। বর্ষায় ঝিরিতে প্রচুর স্রোত থাকে, তাই স্রোতে ভেসে যাওয়ার ঝুঁকি থাকায় সতর্ক থাকুন। যদি ঝর্ণার পানিতে গোসল করতে চান, তবে অতিরিক্ত জামাকাপড় সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলবেন না। যে কোন সমস্যা হলে স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিতে পারেন।
ভ্রমণ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজ ফলো করুন এবং আমাদের ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিন।