আহসান মঞ্জিল ভ্রমণ

পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত আহসান মঞ্জিল একসময় ঢাকার নবাবদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে এটি একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে ঢাকার ইতিহাসের এক বিশিষ্ট অধ্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নওয়াব আবদুল গনি, যিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ-এর নামে এই প্রাসাদের নামকরণ করেন। ১৮৫৯ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৮৭২ সালে এটি সম্পন্ন হয়। এ ভবনটি ঐতিহাসিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ১৯০৬ সালে এখানে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আহসান মঞ্জিল বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে, সর্বশেষ সংস্কারটি সম্পন্ন হয়েছে অতি সম্প্রতি, যার ফলে এটি এখন ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে।

আহসান মঞ্জিলের ইতিহাস

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জালালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ বর্তমান আহসান মঞ্জিলের স্থানে একটি প্রমোদভবন নির্মাণ করেন, যা পরিচিত ছিল “রংমহল” নামে। পরবর্তীতে, তার পুত্র এই রংমহলটি এক ফরাসি বণিকের কাছে বিক্রি করেন, এবং এটি বাণিজ্যিক কুটির হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৮৩৫ সালে, বেগমবাজারের বাসিন্দা খাজা আলীমুল্লাহ এটি কিনে পরিবারসহ বসবাস শুরু করেন। তার ছেলে নওয়াব আবদুল গণি ১৮৭২ সালে ভবনটি নতুন করে নির্মাণ করেন এবং তার প্রিয় পুত্র খাজা আহসানউল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল। ১৮৯৭ সালে ঢাকায় এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ফলে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে দক্ষিণের বারান্দা এবং ইসলামপুর রোড সংলগ্ন নহবত খানাটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যা পরে নবাব আহসানউল্লাহ পুনর্নির্মাণ করেন।

আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্যশৈলী সত্যিই অনন্য এবং চোখে পড়ার মতো। এর ছাদের উপর একটি বিশাল আকৃতির গম্বুজ রয়েছে, যা একসময় ছিল ঢাকার সর্বোচ্চ স্থাপনা। প্রবেশপথের ত্রি-তোরণবিশিষ্ট গঠন এবং ছাদে ওঠার জন্য ব্যবহৃত সিঁড়িগুলো দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। প্রাসাদের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত দু’টি মনোমুগ্ধকর খিলান এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আহসান মঞ্জিলের অভ্যন্তরে মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। পূর্ব অংশে রয়েছে বৈঠকখানা এবং পাঠাগার, আর পশ্চিম অংশে রয়েছে নাচঘর ও অন্যান্য আবাসিক কক্ষ। নিচতলায় আছে দরবার হল এবং একটি ভোজন কক্ষ, যা প্রাসাদের অভ্যন্তরের আরও আকর্ষণীয় অংশগুলোর মধ্যে একটি।

জাদুঘর ভ্রমণ

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নবাব পরিবারের উত্তরসূরিরা আহসান মঞ্জিল বিক্রির চিন্তা করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভবনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সেই পরিকল্পনা বাতিল করেন। তিনি ভবনটিকে একটি জাদুঘর ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। পরে, বিভিন্ন ধাপে পুনঃনির্মাণ এবং সংস্কারের কাজ শেষ হলে, ১৯৯২ সালে আহসান মঞ্জিল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। বর্তমানে এই জাদুঘরে প্রায় ৪ হাজার ৭৭টি নিদর্শন স্থান পেয়েছে, যা দর্শনার্থীদের নবাবী আমলের ইতিহাসের সাথে পরিচিত করায়।

নবাবদের ব্যবহৃত আসবাব, বড় আকারের আয়না, লোহার সিন্দুক, অলংকৃত রুপা ও ক্রিস্টালের তৈরি চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন তৈলচিত্র, রাজকীয় অতিথিদের কক্ষ এবং নাচঘর সবকিছুই জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ। জাদুঘরের কক্ষে কক্ষে রাখা আছে সেই সময়ের সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের নিদর্শনও। প্রতিটি কক্ষ নবাবদের সমৃদ্ধ জীবনধারা এবং ইতিহাসের একেকটি অধ্যায় ফুটিয়ে তোলে, যা প্রতিটি দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করে।

টিকেটের মূল্য

আহসান মঞ্জিল পরিদর্শনের জন্য সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা। তবে ১২ বছরের নিচে অপ্রাপ্ত শিশুরা মাত্র ১০ টাকায় প্রবেশ করতে পারে। সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য টিকিটের মূল্য ৩০০ টাকা এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকদের জন্য ৫০০ টাকা নির্ধারিত। বিশেষ সুবিধা হিসেবে, প্রতিবন্ধী দর্শনার্থীদের জন্য টিকিট প্রয়োজন হয় না। এছাড়া, যদি ছাত্র-ছাত্রীরা আগে থেকে আবেদন করে, তাহলে তারা বিনামূল্যে আহসান মঞ্জিল জাদুঘর দেখতে পারে। এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যে, সকল শ্রেণীর মানুষ যেন এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি পরিদর্শন করতে পারে।

কবে যাবেন আহসান মঞ্জিলে

ঢাকার সদরঘাট যেতে চাইলে যেকোনো বাসে চড়ে জগন্নাথ ইউনিভার্সিটির কাছে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে নেমে যেতে হবে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে অথবা ৩০ টাকা রিকশা ভাড়ায় আহসান মঞ্জিল পৌঁছানো সম্ভব। এছাড়া, ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে রিকশা অথবা সিএনজি নিয়ে সদরঘাটের পথ ধরে আহসান মঞ্জিল দর্শনে যাওয়া যায়। অন্যদিকে, গুলিস্তানের নর্থ সাউথ রোড ধরে নয়াবাজার মোড় হয়ে বাবুবাজার ব্রিজের আগে নেমে রিকশায় আহসান মঞ্জিলে পৌঁছানোও একটি ভালো বিকল্প। সরাসরি আসার জন্য ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে সিএনজিতে চড়ে আহসান মঞ্জিলে চলে আসা যায়।

আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

আহসান মঞ্জিলের সফরের পাশাপাশি, আপনি চাইলে কাছাকাছি অবস্থিত পুরান ঢাকার কিছু দর্শনীয় স্থানও ঘুরে দেখতে পারেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো হল লালবাগ কেল্লা, তারা মসজিদ, আর্মেনিয়ান চার্চ, হোসেনি দালান, বাহাদুর শাহ পার্ক (ভিক্টোরিয়া পার্ক) এবং সদরঘাট লঞ্চঘাট। এছাড়া, পুরান ঢাকায় বিখ্যাত খাবার হোটেলগুলোতেও ঘুরে আসতে ভুলবেন না; এখানের খাবারগুলো অবশ্যই আপনাকে মুগ্ধ করবে।

ভ্রমণ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজ ফলো করুন এবং আমাদের ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিন।

বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে জানিয়ে দিন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top