বাজারে অনেক ভেজাল মধুর ভিরে,খাঁটি মধু চেনার সহজ উপায়

মধুর প্রকারভেদ

মধু মূলত দুই ধরনের—প্রাকৃতিক মধু এবং চাষ করা মধু। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক মধুর মূল উৎস হলো সুন্দরবন, যেখানে মৌয়ালরা বনের গভীরে গিয়ে মধু সংগ্রহ করে, যা সারা দেশে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হয়। অন্যদিকে, গ্রামীণ এলাকা কিংবা বাড়ির আশেপাশে যে মৌমাছির চাক দেখা যায়, তা খুব সামান্য পরিমাণে মধু উৎপন্ন করে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধুতে সাধারণত সাত ধরনের ফুলের মধু মেলে, আর চাষের মধুর ক্ষেত্রে পাঁচ ধরনের ফুল থেকে বেশি পরিমাণে মধু সংগ্রহ করা হয়।

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু

সুন্দরবনে মধু আহরণের মৌসুম শুরু হয় মার্চ থেকে, যখন বিভিন্ন জায়গা থেকে মৌমাছির ঝাঁক সুন্দরবনে আসে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে এপ্রিলের প্রথম দিন থেকেই মৌয়ালরা মধু কাটতে শুরু করেন, যা প্রায় দুই মাস ধরে চলে। প্রথমে আসে খলিশা মধু, যা খলিশা গাছের সাদা ফুল থেকে সংগ্রহ করা হয়। এর রঙ সাদা ও স্বাদ মিষ্টি হওয়ায় চাহিদা বেশি, তবে উৎপাদন কম। এরপর আসে লালচে রঙের গরান মধু, যা বেশি পরিমাণে সংগ্রহ হয় এবং বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায়। মৌসুমের শেষ দিকে পশুর, কেওড়া, বাইন, এবং গেওয়া ফুলের মধু সংগ্রহ করে মৌয়ালরা, যা জুন মাসে শেষ হয়।

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধুর পাশাপাশি, এখন মিশ্র মধুও পাওয়া যায়, যা বিভিন্ন ফুল থেকে সংগ্রহ করা হয়। মধু সংগ্রহের পর ব্যবসায়ীরা তা প্রক্রিয়াজাত করে সারা বছর সংরক্ষণ করেন, যার দাম ৪০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। সুন্দরবন অঞ্চলে বর্তমানে মধুর চাষও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মৌমাছির বাক্স নিয়ে চাষীরা মৌসুমের শুরুতে বনাঞ্চলে যান এবং মৌসুম শেষে মধু সংগ্রহ করে ফেরত আসেন। বিভিন্ন মধুর রং, স্বাদ, গন্ধ এবং ঘনত্বে পার্থক্য থাকে, যা নির্ভর করে ফুলের প্রকারভেদের উপর।

চাষের মধু

সরিষা ক্ষেতের পাশে এখন অনেক কাঠের বাক্স চোখে পড়ে, যেগুলোতে মূলত পোষা মৌমাছি থাকে। এই মৌমাছিগুলো সারাদিন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে বাক্সে ফিরে আসে। বাংলাদেশে সাধারণত পাঁচটি ভিন্ন জাতের মৌমাছি দেখা যায়, যার মধ্যে চারটি পোষা। ঢাকার আরিফুল ইসলাম নামক একজন ব্যক্তি মধু নিয়ে একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং তার নিজস্ব মৌ খামার রয়েছে।

তিনি জানান, বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের দিকে ইউরোপীয়ন জাতের মৌমাছি আনা হয়েছিল, যা এখন বাক্সে পালন করা হয়। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধুর চাষ সবচেয়ে বেশি হয়, কারণ এটি সহজলভ্য এবং এর উৎপাদন খরচ কম। সরিষা ফুলের মধুর ঘ্রাণ তীব্র এবং হালকা সাদাটে সোনালি রঙের হয়। পাইকারি ব্যবসায়ী রুবেল আহম্মেদ জানান, শীতে সরিষা ফুলের মধু সহজেই জমে গিয়ে ক্রিম হয়ে যায়, যা “ক্রিম হানি” নামে পরিচিত। এই মধুর কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।

সরিষার পর মৌমাছির বাক্সগুলো ধনিয়া ক্ষেতে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ধনিয়া ফুল থেকে মধু আহরণ করা হয়। এরপর আসে কালোজিরা ফুলের মধু, যা সংগ্রহের পর কালো হয় এবং এর স্বাদ খেজুরের গুড়ের মতো।

চাষের মধুর মধ্যে লিচু ফুলের মধুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি, যা দেশের উত্তরবঙ্গের লিচু বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয়। লিচুর মধুর রঙ হালকা সাদাটে সবুজাভ এবং খেতে গেলে লিচুর গন্ধও পাওয়া যায়। বর্ষাকালে কুল বা বরই ফুলের মধু সংগ্রহ করা হয়, তবে এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে।

মধু চেনার উপায়

মধু নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে নানা অভিযোগ এবং সন্দেহ রয়ে গেছে, যেমন মধু খাঁটি নাকি ভেজাল। এই সন্দেহ দূর করতে মধু চেনার জন্য তিনটি মূল বিষয় উল্লেখ করেন গবেষক আরিফুল ইসলাম: স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধ। তার মতে, অভিজ্ঞতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; সুন্দরবনের মধুর বিশেষ একটি বুনো গন্ধ থাকে।

মধুর পার্থক্য উদ্ভিদ এবং মৌমাছির জাতের উপর নির্ভর করে। বিক্রেতা রুবেল আহম্মেদ জানান, একেক ফুলের মধুর ঘ্রাণও একেক রকম। যদিও ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে মধুর গুণাগুণ নির্ধারণ করাই সবচেয়ে ভালো, কিন্তু বাংলাদেশে এই সুবিধা সীমিত।

অনেকে প্রচলিত পদ্ধতি যেমন আগুন দেওয়া বা পানিতে মিশিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এসবের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। আরিফুল ইসলাম বলেন, মধু প্রাকৃতিকভাবে চিনি থাকে, তাই পিঁপড়া মধু খাবে।

রুবেল আহম্মেদ আরও জানান, মধু জমে গেলে খাঁটি না, এই ধারণা ভ্রান্ত। সুন্দরবনের মধু সাধারণত জমবে না এবং ফ্রিজে রাখলেও তা ঘনত্ব বাড়ায়। তবে দীর্ঘ সময় ফ্রিজে রাখলে মধুর গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে। শেষ পর্যন্ত, খাঁটি মধুর উপর ফেনার মতো একটি স্তর তৈরি হয়, যা ভেজাল মধুর ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

মধুর উপকারিতা

বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মধুর গুণাগুণ চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি এককভাবে বা ভেষজ দ্রব্যের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

উদাহরণস্বরূপ, চায়ের সঙ্গে মধু ও আদার রস মিশিয়ে পান করলে সর্দি ও শ্লেষ্মা উপশম হয়। তুলসী পাতার রস ও মধু একসাথে মিশিয়ে খেলে কাশি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। গায়কদের জন্য হালকা গরম জলসহ মধু মিশিয়ে গড়গড়া করাও গলার স্বর উন্নত করে, অনেকের মতে এটি টনিকের মতো কাজ করে।

শিশুদের জন্য, এক চা চামচ মধু গরম দুধ বা গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে তাদের দৈহিক গড়ন, রুচি ও ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তবে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে; হজমের গোলমাল, হার্টের অসুখ ও ডায়াবেটিসের রোগীরা আধা চা-চামচের বেশি মধু খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন।

বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে জানিয়ে দিন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top