নিকলী হাওর ভ্রমণ এমন এক অভিজ্ঞতা, যা আপনাকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যাবে। কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলায় অবস্থিত এই হাওরে, আপনি পানির বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝে ছোট ছোট গ্রামগুলোকে দেখতে পাবেন, যা দূর থেকে একেকটি দ্বীপের মতো মনে হয়। স্বচ্ছ জলের মাঝে নৌকায় ভেসে বেড়ানোর সময় আপনি দেখতে পাবেন জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, যা আপনাকে বাংলার জীবনের একটি স্নিগ্ধ প্রতিচ্ছবি উপহার দেবে। নিকলীর হাওরে ভেসে থাকা জলাবন, রাতারগুলের স্মৃতি মনে করিয়ে দেবে, আর হাওরের তরতাজা মাছের স্বাদ আপনাকে আস্বাদন করাবে প্রাকৃতিক খাবারের সৌন্দর্য। ঢাকা বা কিশোরগঞ্জ থেকে খুব সহজেই একদিনের জন্য নিকলী হাওর ঘুরে আসা সম্ভব।
নিকলী ভ্রমণে কখন যাবেন ( উপযুক্ত সময়)
নিকলী হাওরের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বর্ষা মৌসুম, বিশেষ করে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের সময়টা সবচেয়ে ভালো। তখন হাওর ভরে ওঠে পানিতে, আর প্রকৃতি যেন তার সবুজ-নীল রঙের খেলায় মেতে ওঠে। তবে বছরের অন্য সময়গুলোতেও হাওরের নিজস্ব এক ভিন্ন রূপ থাকে, যা উপভোগ করতে চাইলে যে কোনো সময়েই নিকলী ভ্রমণে যেতে পারেন।
নিকলী ভ্রমণে কিভাবে যাবেন
ঢাকার সাথে নিকলীর সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় আপনি ট্রেন বা বাস—যেকোনো মাধ্যমেই সেখানে যেতে পারবেন এবং একই দিনে ফিরে আসতে পারবেন।
ঢাকা থেকে ট্রেনে নিকলী ভ্রমণ: ঢাকা থেকে একদিনের ভ্রমণে নিকলী হাওর দেখতে চাইলে আন্তঃনগর এগারো সিন্ধুর প্রভাতী ট্রেনে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। ট্রেনটি বুধবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে কমলাপুর থেকে ছাড়ে এবং বিমানবন্দর, টঙ্গী, নরসিংদী, ও ভৈরব স্টেশন হয়ে কিশোরগঞ্জে পৌঁছায়। ভাড়ার সীমা ১৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে, শ্রেণি অনুযায়ী। কিশোরগঞ্জ পৌঁছানোর আগের গচিহাটা স্টেশনে নেমে ইজিবাইক বা সিএনজি নিয়ে নিকলী বাজারে যেতে পারেন, যা ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইজিবাইকে জনপ্রতি ভাড়া ৩৫ টাকা, আর রিজার্ভ নিলে খরচ হবে ২৫০-৩০০ টাকা, এবং সময় লাগবে প্রায় ১ ঘণ্টা। সিএনজি রিজার্ভ করলে খরচ পড়বে ৩০০-৩২০ টাকা, সময় লাগবে ৪০ মিনিট। দিনেই ফিরতে চাইলে নিকলী থেকে বাসে ফিরে আসতে হবে।
ঢাকা থেকে বাসে নিকলী ভ্রমণ: ঢাকা থেকে বাসে নিকলী যেতে হলে, গোলাপবাগ বা গুলিস্তান থেকে অনন্যা সুপার বাস অথবা মহাখালী থেকে জলসিড়ি বাসে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলায় প্রথমে পৌঁছাতে হবে। দৈনিক ভোর ৫:৩০ থেকে কিছুক্ষণ পর পর এই বাসগুলো ছাড়ে, এবং ভাড়া পড়বে ২৬০ থেকে ৩৬০ টাকা জনপ্রতি। দিনের মধ্যেই ঘুরে ফিরে আসতে চাইলে, সকাল ৭টার আগে বাসে যাত্রা করা উচিত। কটিয়াদি বাস স্ট্যান্ডে নামলে, সেখান থেকে নিকলী হাওর ২২ কিলোমিটার দূরে। রিসার্ভ সিএনজিতে নিকলী যেতে খরচ হবে ৩৬০-৪৫০ টাকা, আর লোকাল সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ৭০-৮০ টাকা। কটিয়াদি থেকে নিকলী পৌঁছাতে সিএনজিতে প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট লাগবে।
কিশোরগঞ্জ শহর থেকে নিকলী: কিশোরগঞ্জ শহর থেকে নিকলী যাওয়ার জন্যে রেলস্টেশনের পাশেই সিএনজি স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি, সেখানে নিকলীতে যাওয়ার জন্য অনেক সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। লোকাল সিএনজিতে উঠে বসে নিলাম। জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ৭০ টাকা, আর যদি রিজার্ভ করে যেতে চান তবে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার মতো লাগবে। পথে যেতে যেতে দেখতে পেলাম আশেপাশের সবুজ ফসলের মাঠ আর ছোট ছোট গ্রামগুলো, যা শহরের কোলাহল থেকে একেবারেই আলাদা। প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম নিকলী। পুরো যাত্রাটাই ছিল যেন একটা ছোট্ট অ্যাডভেঞ্চার।
ভৈরব থেকে নিকলী যাওয়া: ভৈরব থেকে নিকলী হাওরে যাওয়ার জন্য আমি একদিন ভ্রমণ পরিকল্পনা করেছিলাম। লোকাল সিএনজিতে চড়ে জনপ্রতি ১২০ টাকা খরচ হয়েছিল, আর রিজার্ভ নিলে ৬০০ টাকা। আমি রিজার্ভ সিএনজি নিয়েছিলাম, যা আমাকে দেড় ঘণ্টায় নিকলী পৌঁছে দিয়েছিল।
ভৈরব থেকে নিকলীর পথে যাত্রা করলেই গ্রাম বাংলার অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। রাস্তার দুইপাশের সবুজ মাঠ, নদীর বুক চিরে চলা নৌকা, এবং ছোট ছোট গ্রাম গুলো সত্যিই মনোরম ছিল। নিকলীর দিকে যতই এগোতে থাকি, চারপাশের সৌন্দর্য যেন আরো বেড়ে যাচ্ছিল।
যদি আপনি ট্রেনে আসেন, গচিহাটা বা মানিকখালি স্টেশনে নেমে নিকলী পৌঁছাতে পারেন। আর বাসে আসলে কটিয়াদি স্টেশন থেকে নামলে দ্রুত নিকলী পৌঁছানো সম্ভব। সিএনজিতে উঠলে, চলার পথে গ্রাম বাংলার দৃশ্য দেখেই বোঝা যাবে, নিকলী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কতটা মনোমুগ্ধকর।
খাওয়া-দাওয়া
নিকলী পৌঁছানোর পর, সেখানকার খাবার হোটেলগুলোও বেশ প্রশংসনীয়। আমি গিয়েছিলাম হোটেল সেতু তে। এখানকার খাবার সত্যিই মন জয় করে নিয়েছিল। বিশেষ করে, হাওরের তাজা মাছ দিয়ে তৈরি নানা পদ খুবই সুস্বাদু। ২০০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে আপনি একদম ভরপেট খেয়ে নিতে পারবেন। আর সেই সাথে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে খাবারের এই অভিজ্ঞতা তো আলাদা একটা মাত্রা যোগ করেছিল।
কিভাবে ঘুরা-ঘুরি করবেন
খাওয়া দাওয়া ও প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ইজিবাইকে বেড়ি বাঁধের শেষ প্রান্তে চলে গেলাম। এখানে গিয়ে আমি দরদাম করে এক ঘণ্টার জন্যে নৌকা ঠিক করলাম হাওর ঘুরে দেখার জন্যে। ছোট নৌকার ভাড়া ঘন্টা প্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আর একটু বড় নৌকার ভাড়া ঘন্টা প্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। একসাথে কিছু বন্ধু নিয়ে গেলে পছন্দমতো নৌকা রিসার্ভ করা যায়, এক নৌকায় ১০-৩০ জন পর্যন্ত উঠতে পারবেন। তবে দরদাম করে ভাড়া ঠিক করে নেওয়াটা উচিত।
আমি ৩ ঘণ্টার জন্যে নৌকা ভাড়া করলাম। প্রথমেই ছাতিরচর গ্রামে চলে গেলাম। সিলেটের রাতারগুলের মত জলাবনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চোখে সুখের ছোঁয়া লাগলো। শীতল জলে গা ডুবিয়ে শান্ত হওয়ারও সুযোগ পেলাম। বর্ষাকালে পানি বেশি থাকে, তাই গোসল করতে চাইলে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে যাওয়াটা ভালো।
এরপর চর মনপুরায় গেলাম। পানি বেশি হলে চরটি ডুবে যায়, তবে পানি কম থাকলে আধো ভাসমান এই চরে কিছু সময় ঘুরে বেড়ালাম।
শেষ বিকেলের সূর্য্য দেখে ফেরার পথে নিকলী বেড়ি বাঁধে ফিরে এলাম। যদি ট্রেনে ঢাকায় ফিরতে চান, বিকেল ৪টার আগেই গচিহাটা স্টেশনে ফিরতে হবে কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন ধরার জন্যে। তা না হলে বাসে ফিরতে হবে। এই জন্য নিকলী উপজেলা মোড়ে এসে সিএনজি নিয়ে কটিয়াদি বাস স্ট্যান্ডে চলে গেলাম। ঢাকা যাবার শেষ বাস সন্ধ্যা ৭টায় ছেড়ে যায়। সময় ঠিক রেখে পরিকল্পনা করা ভালো।
নিকলী, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম ট্রাভেল পরিকল্পনা
নিকলী ঘুরে আসার পর আমি কিছুটা সময় পেয়েছিলাম মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের হাওর রোড দেখার জন্যও। নিকলী থেকে নৌকায় মিঠামইনে যেতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগে। সুতরাং, এই যাত্রার সময় হিসেব করে আপনার প্ল্যান করুন।
মিঠামইনে পৌঁছে কিছুটা সময় ঘোরাফেরা করার সুযোগ থাকবেই। তবে মনে রাখবেন, নিকলী থেকে মিঠামইন হয়ে হাওর রোড দেখতে হলে নৌকা রিসার্ভের খরচ বাড়তে পারে। তাই আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনায় সময়ের সাথে সাথে বাজেটের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে। আমি নিজে যেভাবে মিঠামইন ও হাওর রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি, আশা করি আপনি কেও সুন্দর অভিজ্ঞতা পাবেন।
থাকবেন কোথায়
নিকলীতে গিয়ে আমি কিছু নতুন আবাসিক হোটেল দেখেছি যা পর্যটকদের জন্য বেশ উপযুক্ত। হোটেলগুলো মোটামুটি মানের, আর স্থানীয় উপজেলা ডাক বাংলো তেও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। যদি আপনি নৌকায় অথবা ক্যাম্পিং করে রাত কাটানোর পরিকল্পনা করেন, তাহলে নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক থাকুন। স্থানীয়দের সাহায্য নিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন। এছাড়া, কিশোরগঞ্জ জেলার শহরে বেশ কয়েকটি ভালো হোটেল পাওয়া যাবে যেখানে থাকা আরও সুবিধাজনক হতে পারে।
নিকলীর আরও কিছু স্থান, যেখানে ঘুরে আসতে পারেন
নিকলীর ভ্রমণের সময় আমি কিছু দারুণ স্থান ঘুরে দেখার সুযোগ পেলাম। প্রথমে আমি গুরই শাহী জামে মসজিদ দেখতে গিয়েছিলাম। সহজেই রিকশা বা মটরসাইকেলে সেখানে পৌঁছানো যায়। মসজিদের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এরপর নিকলী বেড়িবাঁধ দেখতে বের হলাম। এটা উপজেলা অফিসের সামনে থেকে শুরু হয়, তাই হেঁটে হেঁটে পুরো বেড়িবাঁধের সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব।
পাহাড় খাঁর মাজারও দর্শনীয় একটি স্থান, যা উপজেলা থেকে ট্রলারে অথবা মটরসাইকেলে যাওয়া যায়। এছাড়া, গুরই প্রাচীনতম আখড়া দেখা এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। শুকনো মৌসুমে রিকশা, মটরসাইকেল বা সিএনজির মাধ্যমে সেখানে পৌঁছানো যায়, তবে বর্ষা মৌসুমে নৌকা বা ট্রলার ব্যবহার করতে হয়। এসব জায়গায় ঘুরতে গিয়ে স্থানীয় মানুষের আন্তরিকতা ও সংস্কৃতি গভীরভাবে অনুভব করতে পেরেছি।
নিকলীর আশপাশে কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা আপনার সফরকে আরও স্মরণীয় করে তুলতে পারে:
- ছাতিরচর গ্রাম: এই গ্রামে গিয়ে আপনি হাওরের জলাবন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মুগ্ধতা উপভোগ করতে পারবেন। এখানে পানি বেশি হলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আরও প্রভাবশালী হবে।
- চর মনপুরা: এটি হাওরের মধ্যবর্তী একটি চর, যেখানে কম পানি থাকলে ঘুরে বেড়ানো যেতে পারে। এখানে গা ভাসিয়ে এবং সূর্যাস্ত দেখতে পেতে পারেন।
- মিঠামইন হাওর: নিকলী থেকে নৌকায় পৌঁছাতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগে। এটি আরও বড় হাওর রোডের অংশ, যেখানে আপনি অদেখা সৌন্দর্য দেখতে পারবেন।
- অষ্টগ্রাম হাওর: মিঠামইন থেকে নৌকায় চলে যাওয়া যায়, এটি আরো বৃহৎ হাওর এলাকা, যা ঘুরে দেখার জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।
নিকলী এবং এর আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ঘুরে দেখলে আপনি প্রকৃতির একটি অপরূপ রূপ এবং গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্বাদ পেতে পারবেন।
নিকলী হাওরের পানির মাঝে নৌকা ভাসিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। ছাতিরচর গ্রামে সিলেটের রাতারগুলের মতো জলাবন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বিশাল হাওরের মাঝে সূর্যাস্তের দৃশ্য ছিল সত্যিই চমৎকার।
ভ্রমণ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজ ফলো করুন এবং আমাদের ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিন।